ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম এর জন্ম ১৯৭৭ সালে নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলাধীন সপ্তগাঁও এর রুদ্ররামপুর গ্রামে এক বনেদী মুসলিম পরিবারে। তার বাবা একজন সৎ ও আদর্শ স্কুল শি¶ক ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম ছোট বেলা থেকে স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে বিশ্ব ঘুরে দেখবেন। পাড়ি দিবেন তের নদী আর সাত সমুদ্র কিন্তু কিভাবে! ছোট্ট এই শিশুটির তা জানা ছিল না। অত্যন্ত মেধাবী ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম কৃতিত্বের সাথে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তারপর তার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমিতে ভর্তি হন। শুরু হলো সমুদ্র আর জাহাজের সাথে সখ্যতার এক নতুন অধ্যায়। তিনি নতুন জীবনের সন্ধান পেলেন। সমুদ্রগামী জাহাজে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে এগার বছর অতিবাহিত করে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ওশেন মেরিন সার্ভিস (ওয়ার্কশপ)। এরপর তিনি এদেশে দক্ষ জনশক্তি বা মানব সম্পদ গড়ার লক্ষ্যে ২০১২ সালে চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন ওশেন মেরিটাইম একাডেমি ও ওশেন মেরিটাইম ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। মানবসম্পদ গড়ার পাশাপাশি মেরিনারদের বিভিন্ন দেশে পাঠানো এবং বিদেশী জাহাজে উঠানোর জন্যে তিনি ম্যানিং এজেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন। যা গোল্ডেন ক্যারিয়ার শীপ-ম্যানেজমেন্ট নামে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত। উলেখ্য তাদের এ পর্যন্ত পাশকৃত সকল ক্যাডেট চাকুরীর সুযোগ পেয়েছে। সম্প্রতি বাজেট নিয়ে তারুণ্যদীপ্ত এই সফল উদ্যোক্তা ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম -এর মুখোমুখী হলে তিনি মেরিটাইম সেক্টরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অর্থদিগন্ত প্রতিবেদককে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাতকার প্রদান করেন। নিম্নে সাক্ষাতকার চুম্বকীয় অংশটুকু পাঠকের উদ্দেশ্যে তুলে ধরা হলো।
আগামী ১০ বছরে ১ লক্ষ দক্ষ মেরিনার তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারী এবং বেসরকারী মেরিন সেক্টরে প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওশেন মেরিটাইম একাডেমী
অর্থদিগন্তঃ আপনার মতে আসন্ন জাতীয় বাজেটে (২০১৯-২০) মেরিন সেক্টরের এর গুরুত্ব কেমন?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ সময়োপযোগী একটি প্রশ্ন করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার মতে, বাংলাদেশের বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত বাংলাদেশের মেরিন সেক্টর। বর্তমান সরকার সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে Blue Economy কে। Blue Economy বিষয়টি সাধারণ মানুষ খুব একটা না বুঝতে পারলেও আমাদের সরকারের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা খুব ভালভাবেই ব্যাপারটি বুঝতে পারবেন।
Blue Economy বলতে আমরা শুধু সমুদ্রের আভ্যন্তরীণ সম্পদকেই বুঝি। যেমন- প্রাকৃতিক সম্পদ, খনিজ সম্পদ, বিভিন্ন প্রকার মাছ, শৈবাল, আকর, মূল্যবান পাথর ইত্যাদি। আসলে Blue Economy এর মধ্যে শুধু এগুলোই না সারা পৃথিবীর চার ভাগের এক ভাগ স্থল আর তিনভাগ পানি। এই তিনভাগ পানির মধ্যেই পৃথিবীর ব্যবসা বাণিজ্যের প্রায় ৯০ ভাগ হয় জাহাজের মাধ্যমে। আর এই সকল জাহাজে দক্ষ শ্রমিক ও নাবিকের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বাণিজ্যিক জাহাজে যে সকল শ্রমিকরা কাজ করে তাদের চাকরির বাজারকে যদি আমরা একটা পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারি এবং আমরা যদি এই বাজারের মাত্র ৫% দক্ষ শ্রমিক সরবরাহ করতে পারি তাহলে আমাদের দেশের জন্য খুলে যেতে পারে একটি বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার।
আমাদের দেশে রয়েছে প্রচুর মানব সম্পদ ও শিক্ষিত জনশক্তি। আমরা তাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পেরেছি কিন্তু তাদের জন্য সঠিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। এই ক্ষেত্রে আমরা যদি শিক্ষার্থীদের মেরিন সেক্টরে আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে পারি এবং তাদেরকে যদি বিশ্ব বাজারে পাঠাতে পারি তাহলে সারা পৃথিবীতে যে চাকরির বাজার রয়েছে আমরা তা ধরতে পারবো। তবে এই ক্ষেত্রে আমাদের কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে। যেমন-
ক. আসন্ন জাতীয় বাজেটে বেসরকারি মেরিন সেক্টরের উন্নয়নে একটি নির্দিষ্ট অর্থ বরাদ্দ নির্ধারণ করতে হবে।
খ. দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।
গ. আগামী ১০ বছরে ১ লক্ষ দক্ষ মেরিনার তৈরি করার লক্ষ্যে সরকারী এবং বেসরকারী মেরিন সেক্টরে প্রয়োজনীয় সকল কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। এ সংখ্যাকে ৫ লক্ষ্যে উন্নীত করার জন্য মহা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।
দক্ষ মানব সম্পদ তৈরির মাধ্যমে ১ লক্ষ মেরিনারকে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারে চাকুরি দেয়ার মাধ্যমে প্রায় ১ কোটি সাধারণ শ্রমিকের থেকে বেশি টাকা আয় করা সম্ভব।
এ জন্য এই সম্ভাবনার কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত আসন্ন বাজেটে এই মেরিন সেক্টরকে নিয়ে বিশেষ করে বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নে একটি দীর্ঘমেয়াদী ঋণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
অর্থদিগন্তঃ মেরিন সেক্টরের চাকুরীর বাজারে বর্তমান অবস্থা স¤পর্কে বলেন।
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ বর্তমানে মেরিনারদের চাকুরীর বাজারটি আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। বাংলাদেশে প্রয়োজনের তুলনায় মেরিনারের সংখ্যা অনেক কম। মাত্র ৮/১০ হাজার মেরিনার আছে আমাদের দেশে। এতো অল্প সংখ্যক মেরিনার দিয়ে বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করা যায় না। তবে অনেক নতুন নতুন বাজার তৈরী হচ্ছে। বর্তমানে চায়নাতে প্রচুর Crew এর চাহিদা রয়েছে। অচিরেই অফিসার ডিমান্ডও আসবে। কিন্তু সে চাছিদা মেটানোর মত সামর্থ্য বা প্রস্তুতি আমাদের নেই। আমাদের প্রচুর দক্ষ মেরিনার তৈরী করা প্রয়োজন।
অর্থদিগন্তঃ বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আপনার ধারণা কি?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বলা একটি বিশাল ব্যাপার এবং এই ব্যাপার সম্পর্কে বলার মত এতটা যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমি এটুকু বলতে পারি বর্তমান সরকার যে উন্নয়নের গতি তৈরি করছে তাকে ধরে রাখতে হলে বিদেশে আমাদের শ্রম বাজারকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। শ্রমের নতুন নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। যাতে আমাদের দেশে আরো বেশি রেমিটেন্স আসে। রফতানির ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরও উদ্যোগী হতে হবে। সরকারকে নতুন নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে উৎসাহিত করতে হবে।আমরা দেখতে পারি- এখন আগের মত রাস্তায় গাড়ি পোড়ানো হয় না, হরতাল হয় না এবং এই কারণে দেশটা অনেকটা স্থিতিশীল রয়েছে এবং এটা ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ। আর ব্যবসা বান্ধব পরিবেশ বজায় থাকলেই কেবল বৈদিশিক বিনিয়োগ আশা করা যায়। এখনও বিশ্বের অনেক দেশ রয়েছে যারা আমাদের দেশে বিনিয়োগ করতে চায় এমনকি বাংলাদেশে যে সকল শীপ বিল্ডিং রয়েছে সেখানে তারা জাহাজ তৈরির জন্য বিনিয়োগ করতে চায় এবং বাংলাদেশ থেকে জাহাজ তৈরি করে নিতে চায়। ইতোমধ্যে আমাদের দেশে জাহাজ তৈরি হচ্ছে। এখন বিদেশী কোম্পানিগুলো যদি বেশি বেশি অর্ডার দেয় তখন সেখানে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। এছাড়াও মেরিন সেক্টরের আরও যে সকল সেক্টর রয়েছে সেগুলোও ধীরে ধীরে উন্নত হবে কিন্তু এজন্য দেশে স্থিতিশীল অবস্থা থাকতে হবে। যখন এসব কিছু ঠিক থাকবে দেশে স্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করবে এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাদেরকে কোন রকম হেনস্তা করা হবে না তখন আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও এগিয়ে যাবে।
অর্থদিগন্তঃ আপনার সেক্টর থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের প্রত্যাশা কি?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া সবচেয়ে বড় প্রত্যাশা আমাদের মেরিন সেক্টরট কে ডেভেলপ করার জন্য তার একান্ত হস্তক্ষেপ কামনা করছি।বাংলাদেশ মেরিন একাডেমি নামে যে প্রতিষ্ঠানটি রয়েছে সেটি আমাদের মাথার মুকুট এবং এটি অনেক উঁচু লেভেলের একটি প্রতিষ্ঠান। এই পৃথিবীতে প্রথম সারির ১০টি মেরিন একাডেমির মধ্যে এটি একটি। এছাড়া প্রাইভেট সেক্টরেও আমাদের কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেগুলো বাংলাদেশের দক্ষ মেরিনিয়ারদের দেশের বাইরে চাকরি দেয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয়, তাহল আমাদের দেশে এখনও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে মানুষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান হিসেবে Treat করে এতে তারা তাদের কাজের সঠিক গতি ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বিদেশীরা। গত দুই বছরে আমি প্রায় ৩০০ লোককে চাকরি দিয়েছি কিন্তু এখানে যদি শুধু ৩০০ লোক ভাবা হয় তবে তা ভুল হবে ৩০০ লোকের সাথে জড়িত রয়েছে ৩০০টি পরিবার এবং আরোও অনেকে। যার কারণে আমরা চাই সরকার এবং আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ঢাকা ও চট্টগ্রামে কিছু জায়গা বরাদ্দ করা এবং ঋণের ব্যবস্থা করতে পারেন যার মধ্যে মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় তবে বিদেশীরা দক্ষ শ্রমিক ও নাবিক নিতে আরও বেশি আকৃষ্ট হবে।
অর্থদিগন্তঃ মেরিন সেক্টর নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ এই সেক্টর নিয়ে আমার ভবিষ্যত পরিকল্পনা অনেক। আমি ২০১২ সাল থেকে আমার এই প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করে আসছি। এই সময়ে আমি প্রায় ৫০০ লোকের চাকরির ব্যবস্থা করেছি এবং আমি একটি টার্গেট নির্ধারণ করেছি আগামী ১ বছরে আমি আরও প্রায় ৫০০ লোকের জন্য চাকরির ব্যবস্থা করতে পারবো এবং এইভাবে যদি আমি একটা চাকরির বাজার তৈরি করতে পারি তাহলে ইনশাল্লাহ আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ১০ হাজার মেরিনারের চাকরির ব্যবস্থা করে আমি একটি ভলিউম তৈরি করতে চাই। এখন পুরো দেশের মেরিনারের সংখ্যা মাত্র ১০,০০০ জন। আমার মত আরো ৫ জন যদি এই কাজটি সফলতার সাথে করে তবে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহ এ সংখ্যা ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যাবে।আমরা যদি সহজ শর্তে ঋণ পেতে পারি, তবে এসব দরিদ্র শিক্ষার্থীদের শিক্ষাকালীন পূর্ণ সাপোর্ট দিতে পরবর্তীতে তাদের বেতন থেকে তা তুলে নিতে পারতাম। এতে উভয় পক্ষ লাভবান হব। দেশ অনেক বেশি সমৃদ্ধ হবে।দেখা যায় অনেক সময় অনেক দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা মেরিনে ভর্তি হবার জন্য আসে কিন্তু আমরা সবাই জানি মেরিনে পড়াশুনা করা অনেক ব্যয়বহুল তারপরও আমি অনেক মেধাবীদের জন্য ১৫-২০% স্কলারশীপের ব্যবস্থা করে থাকি এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে আমরা অনেকদের ৫০% স্কলারশীপের ব্যবস্থাও করে থাকি।