দেশের জনপ্রিয় ও সর্বাধিক পঠিত মাসিক শিল্পকন্ঠ পত্রিকায় ওশেন মেরিটাইম একাডেমীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মারুপ মো জহিরুল ইসলাম এর একটি বিশেষ সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়। উক্ত সাক্ষাতকারটি এখানে তুলে ধরা হলোঃ

 

মেরিটাইম সেক্টর দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম
ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ওশেন মেরিটাইম একাডেমী

তারুণ্যই উদ্যম, তারুণ্যই শক্তি, আর সেই তারুণ্য যদি হয় মেধাবী উদ্যোক্তা তাহলে তার উদ্যোগ যে সাফল্যের সোনালি সিঁড়িতে পা রাখবে এটা খুবই স্বাভাবিক। দেশের মেরিটাইম সেক্টরকে এগিয়ে নিতে যে কয়জন মানুষ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন সফল মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম। তিনি তার মেধা, কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন এই সেক্টরকে। স্বপ্ন দেখেন ভবিষ্যতে মেরিটাইম সেক্টর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে গার্মেন্টস্ সেক্টরের পরেই অবস্থান করবে। এই সফল তারুণ্য উদ্যোক্তা নোয়াখালী জেলার চাটখিল উপজেলার এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৭৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা একজন সৎ, আদর্শ স্কুল শিক্ষক ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলাম সফলতার সহিত উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ মেরিন ফিশারিজ একাডেমীতে ভর্তি হন। তিনি সমুদ্রগামী জাহাজে দীর্ঘ ১২ বছর মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে সফলতার সহিত দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে তিনি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে গড়ে তোলেন ওশেন মেরিন সার্ভিস (ওয়ার্কশপ)। পাশাপাশি দেশে দক্ষ জনশক্তি এবং দক্ষ মানব সম্পদ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ২০১২ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন ওশেন মেরিটাইম একাডেমী এবং ওশেন মেরিটাইম ট্রেনিং ইন্সটিটিউট। তার এই প্রতিষ্ঠানগুলো খুব অল্প সময়ে সকলের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং দেশের অর্থনীতিতে রেখে চলেছেন প্রতিনিয়ত অবদান। সম্প্রতি এই সফল তারুণ্য উদ্যোক্তার মুখোমুখি হলে তিনি শিল্পকণ্ঠকে একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কাজল আরিফ।

শিল্পকণ্ঠঃ পড়াশোনা শেষ করে অনেকেই চাকুরী করে কিন্তু আপনি উদ্যোক্তা হলেন কেন?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ
 পড়ালেখা শেষ করে প্রথমে চাকুরীতেই যোগদান করি। সেখানে টানা ১২ বছর সফলতার সাথে চাকুরী করি। পরবর্তীতে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে উদ্যোক্তা হয়েছি। চাকুরীকালীন সময়ে আমি মেরিনারদের যথেষ্ট পরিমানে সমস্যা দেখি। সেগুলো দেখেই মুলত আমি উদ্যোক্তা হওয়ার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের মেরিন সেক্টর অত্যন্ত বড় একটি সেক্টর কিন্তু এখনো এ সেক্টরটি সেভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেনি। কিন্তু আমি অফুরন্ত সম্ভাবনাময় এই সেক্টরকে এগিয়ে নিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি। এটাই মূলত আমার উদ্যোক্তার মুল কারণ।

শিল্পকণ্ঠঃ ওশেন মেরিটাইম একাডেমীর শুরুর প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানতে চাই।
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ আমি প্রথমেই বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে যে সমস্ত জাহাজ আসে সেগুলোতে রিপেয়ারিং ও সাপ্লাই এর কাজ শুরু করি। পরবর্তীতে মানব সম্পদ উন্নয়নের লক্ষ্যে ওশেন মেরিটাইম একাডেমী যাত্রা শুরু করে। বিশ্বে মেরিটাইম সেক্টর বিশাল একটি সেক্টর। পৃথিবীর মোট বাণিজ্যের ৯০ শতাংশই জাহাজের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়ে থাকে। আর এই জাহাজগুলোতে যারা চাকুরী করেন তাদের দক্ষ হিসেবে গড়ে তুলে চাকুরীর ব্যবস্থা করাই হলো ওশেন মেরিটাইম একাডেমীর লক্ষ্য। ইতমধ্যে আমাদের এই প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য নাবিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশ বিদেশের বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানীতে সুনামের সহিত চাকুরী করছেন।


শিল্পকণ্ঠঃ বাংলাদেশের মেরিটাইম শিক্ষার্থীদের জন্য সম্ভাবনা কেমন রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ বাংলাদেশে মেরিটাইম শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশ একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশ। এখানে প্রচুর শিক্ষিত বেকার রয়েছে। সেই সমস্ত বেকার ছেলেদের সঠিক ও আধুনিক শিক্ষার মাধ্যমে চাকুরীর সুব্যবস্থা করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ। এক্ষেত্রে মেরিটাইম এডুকেশন অত্যন্ত বড় সম্ভাবনাময় সেক্টর। যে শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীগণ আন্তর্জাতিক মানের সনদ ও চাকুরী দুটোই পেয়ে থাকে। মেরিনারদের চাকুরীর বেতনও যথেষ্ট ভালো। তাছাড়া বিশ্ব ভ্রমন ও বহুজাতিক মানুষের সাথে মেশার অফুরন্ত সুযোগতো রয়েছেই। বাংলাদেশে মেরিনের সংখ্যা মাত্র দশ হাজার। বাংলাদেশ মেরিন সেক্টরের একটি বৃহৎ রাষ্ট্রে পরিণত হবে এবং গার্মেন্টস্ সেক্টরের পরেই অচিরেই দ্বিতীয় বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত হিসেবে পরিগণিত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

শিল্পকণ্ঠঃ ওশেন মেরিটাইম একাডেমীতে বর্তমানে কতজন শিক্ষার্থী রয়েছে?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ ওশেন মেরিটাইম একাডেমীতে বর্তমানে অনেকগুলো কোর্স চালু রয়েছে। এ কোর্সগুলোতে বর্তমানে প্রায় ২০০ জনের মতো ছাত্র রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ১১ হাজার মেরিনারদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান করেছি আমরা। তারা বিভিন্নভাবে কর্মক্ষেত্রে সুনামের সহিত অবদান রেখে চলেছেন।

শিল্পকণ্ঠঃ দেশের মেরিটাইম সেক্টরের সম্ভাবনা সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ দেশের মেরিটাইম সেক্টর ব্যাপক সম্ভাবনাময় খাত। এখানে জাহাজ তৈরী শিল্প, মৎস্য শিল্প, সামুদ্রিক মুল্যবান ধাতু, খনিজ সম্পদ এবং মানব সম্পদ মিলিয়ে বিশাল জগত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এই খাতকে Blue Economy হিসেবে ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশের দক্ষিণে বে অব বেঙ্গল বেষ্টিত বিশাল সমুদ্রসীমার প্রায় দুই লাখের অধিক জেলে পরিবার রয়েছে। বাংলাদেশ সেইসব জেলে পরিবার ও ফিশিং ট্রলারের মাধ্যমে প্রচুর মৎস্য আহরণ করে দেশের মানুষের প্রোটিনের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও মাছ রপ্তানী করে। এছাড়াও দেশের জাহাজ শিল্প খাত নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। জাহাজ শিল্পখাতের মাধ্যমেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে এবং বাংলাদেশের আরো নতুন নতুন সমুদ্র বন্দর তৈরি করা হচ্ছে। যেগুলো দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। সিঙ্গাপুর একসময় একটি জেলে অধ্যুসিত ছোট দ্বীপ রাষ্ট্র ছিলো। শুধুমাত্র একটি বন্দর দিয়ে তারা আজ সফলতার সর্বোচ্চ শিখরে উন্নীত হয়েছে। কাজেই আমাদের দেশের বন্দরগুলোতে সেই ধরণের সম্ভাবনাই রয়েছে। 

শিল্পকণ্ঠঃ দেশের অর্থনীতিতে কি ধরণের অবদান রাখছে মেরিটাইম সেক্টর?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ দেশের অর্থনীতিতে মেরিটাইম সেক্টরের অবদান ব্যাপক। শুধুমাত্র একটি বন্দরকে দিয়েই যদি সিঙ্গাপুর এই পর্যায়ে আসতে পারে তাহলে আমাদের দেশের চারটি বন্দর ও প্রচুর পরিমানে নদী অর্থনীতিতে কতোটুকু অবদান রাখতে পারে তা বিশে­ষণ করলেই বোঝা যায়, তার সাথে মৎস্য সম্পদ, জাহাজ শিল্প ও খনিজ সম্পদ রয়েছে এবং দেশের মেরিনারদের দ্বারা যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় তাও প্রচুর। পাশাপাশি মেরিনারদের সংখ্যা যতো বাড়বে ততোই আমাদের রেমিট্যান্স বৃদ্ধি পাবে। 


শিল্পকণ্ঠঃ মেরিটাইম সেক্টরে কি ধরণের সমস্যা রয়েছে?
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ মেরিটাইম সেক্টরের আছে একটি বিশাল পরিধি। এই সেক্টর নিয়ে আমাদের সরকারী অফিস ও সংশি­ষ্ট দপ্তর সমূহ তাদের ধারনার অভাবে যুগোপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় এই সেক্টরটি সেইভাবে বিকশিত হতে পারেনি এবং এই সেক্টরে এতদিনেও যথেষ্ঠ দক্ষ মানব সম্পদের অভাব রয়েছে। এখানে সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরী প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। তাহলেই বিকশিত হবে এই শিল্প।

শিল্পকণ্ঠঃ আপনার ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাই।
ইঞ্জিনিয়ার মারুপ মোঃ জহিরুল ইসলামঃ আমি মেরিন সেক্টরে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান করে যেতে চাই। যেখান থেকে জ্ঞান আহরণ করে বাংলাদেশের মেরিন সেক্টরের সমস্ত ডিপার্টমেন্টে তারা অবদান রাখতে পারে এবং সারা পথিবীর মেরিন সেক্টরে ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের পরবর্তী দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত হিসেবে মেরিন সেক্টরকে পূর্ণাঙ্গরূপে বিকশিত করতে পারলেই আমার স্বপ্ন এবং পরিশ্রম সার্থক হবে।